ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত সোমবার রাতভর বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সাত শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, আগের দিন সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৫০০। হামলা ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় লাশ চিনতে শিশুসন্তানদের শরীরে নাম লিখে রাখছে গাজার লোকজন। সংঘাতের মধ্যেই গত সোমবার দুই জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস।
তা সত্ত্বেও ইসরায়েল বলেছে, অচিরেই বিমান হামলা বন্ধ হচ্ছে না। এরই মধ্যে মুসল্লিদের জন্য আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনের পক্ষ নেওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে ইসরায়েলি হামলায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজায় মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজারেরও বেশি শিশু রয়েছে।
দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে শত শত শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় শনাক্ত করা যায়নি। তাই সন্তান মারা গেলে যাতে লাশ শনাক্ত করা যায়, সেই উদ্দেশে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের শরীরে নাম লিখে রাখছেন। গাজার জনাকীর্ণ হাসপাতালগুলোতে এমন অনেক শিশুর দেখা মিলেছে।
গাজার আল-আকসা মার্টার্স হাসপাতালের মর্গে তিনটি শিশুর লাশ ছিল। তাদের পায়ের দিক থেকে প্যান্টের ওপরের দিকে তুলে দেখা হচ্ছিল—কালো কালিতে কোনো নাম লেখা আছে কি না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান আব্দুল রহমান আল মাসরি বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, সন্তানদের পায়ে ও পেটে নাম লিখে রেখেছেন অভিভাবকরা। যেকোনো কিছু ঘটার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তাঁরা। হয়তো নাম লিখে না রাখলে সন্তানদের শনাক্ত করতে না পারার আশঙ্কা ছিল তাঁদের।
এর একটাই অর্থ—গাজার লোকজন যেকোনো মুহূর্তে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে নিহত অথবা আহত হওয়ার আশঙ্কা করছে।’
হাসপাতালটির এক কর্মী বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি—অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের পায়ে নাম লিখে রেখেছেন, যাতে বিমান হামলায় মারা গেলে বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের শনাক্ত করা যায়। নতুন এই কৌশলটি সম্প্রতি গাজায় শুরু হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, অনেক শিশু নিখোঁজ। মাথার খুলি ভাঙা অবস্থায় অনেক শিশুকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের শনাক্ত করা অসম্ভব। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শুধু শরীরে নাম লিখে রাখলেই শিশুদের শনাক্ত করা যাবে।
হামলা অব্যাহত
গত সোমবার রাতভর গাজার উত্তরাঞ্চলের আল-শাতি ও জাবালিয়া শরণার্থী শিবির, মধ্যাঞ্চলের আল-বুরেইজ এবং দক্ষিণের রাফাহ ও খান ইউনিস এলাকায় হামলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় মৃতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। এর মধ্যে মসজিদও রয়েছে। কারণ মসজিদে হামাস সদস্যরা বৈঠক করে। এর আগের দিন ৩২০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
আইডিএফ বলেছে, হামাসের অবকাঠামোয় এসব হামলা চালানো হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হামলা অব্যাহত থাকবে।
গতকালও হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তেল আবিবকে লক্ষ্য করে রকেট ছুড়েছে তারা। এতে পাঁচজন ইসরায়েলি আহত হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ হারজি হালেভি বলেছেন, গাজায় প্রাণঘাতী বিমান হামলা বন্ধের কোনো ইচ্ছা নেই তাদের।
তিনি বলেন, ‘আমরা হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে চাই। দক্ষিণ গাজায় অভিযানের জন্য আমরা প্রস্তুত।’
এর মধ্যেই গতকাল ইসরায়েল সফর করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। সফরকালে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরে রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন তিনি।
আল-আকসা মসজিদ বন্ধ
অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ইসলামী ওয়াকফ বিভাগ জানিয়েছে, কোনো মুসল্লিকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
গতকাল সকাল থেকে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে শুধু ইহুদিরা প্রবেশ করেছে। শুধু ইহুদিদেরই প্রার্থনার সুযোগ দিয়েছে পুলিশ। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, আল-আকসায় নিয়ম ভঙ্গ করে ইহুদিরা প্রার্থনা করেছে।
দুই জিম্মিকে মুক্তি
গত সোমবার রাতে হামাসের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছেন দুই ইসরায়েলি নারী। তাঁদের একজন ৮৫ বছর বয়সী ইসরায়েলি নারী ইয়োমেভেদ লিফশিত্জ। জিম্মি অবস্থায় কেমন ছিলেন এবং হামাস সদস্যরা কেমন আচরণ করেছে, মুক্তির পর তা জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল তেল আবিবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ইসরায়েলের কিবুত্জ এলাকা থেকে আটকের পর মোটরসাইকেলে করে তাঁকে গাজায় নেওয়া হয়। এ সময় তিনি কিছুটা আঘাত পান। মাটির নিচে একটি সুড়ঙ্গে রাখা হয়েছিল তাঁকে।
তাঁকে নিতে আসা হামাসের লোকজন বলেন, ‘আমরা পবিত্র কোরআনে বিশ্বাস করি। আমরা আপনাকে আঘাত করব না।’
তিনি আরো জানান, একজন চিকিৎসক জিম্মিদের দেখে যেতেন। তাঁদের যে খাবার দেওয়া হয়েছে, হামাস সদস্যরাও তা-ই খেয়েছেন।
এদিকে হামাসের জিম্মায় থাকা লোকজনের তথ্য জানতে চেয়ে গাজায় লিফলেট বিতরণ করেছে ইসরায়েল। বিনিময়ে নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। ইসরায়েল জানিয়েছে, এখনো হামাসের কাছে দুই শর বেশি ব্যক্তি জিম্মি অবস্থায় আছে।
‘বিনা কারণে হামলা করেনি হামাস’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গাজা উপত্যকায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে।
গুতেরেস বলেন, হামাসের হামলা যে বিনা কারণে হয়নি, এর স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। ৫৬ বছর ধরে দখলদারিত্বের শিকার ফিলিস্তিনের জনগণ। তারা ক্রমাগত নিজেদের ভূমি গ্রাস হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে, বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, লোকজন বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশাও লোপ পেয়েছে। এই বক্তব্যের পর গুতেরেসের পদত্যাগ চেয়েছেন জাতিসংঘে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান।
পরিষদের বৈঠকে অংশ নিয়ে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যেকোনো রাষ্ট্রের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে জাতিসংঘের সম্মতি থাকা উচিত। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি বেসামরিক নাগরিকের জীবন সমানভাবে মূল্যবান।’ সূত্র : সিএনএন, আলজাজিরা, বিবিসি
পাঠকের মতামত